কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগালের পর যুক্তরাজ্যও আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঠিক এমন সময় ইসরাইল দখলকৃত পশ্চিম তীরে নতুন বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে এবং গাজায় যুদ্ধ আরও জোরদার করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি ও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অবস্থান আমূল বদলে দিতে পারে। গাজার চলমান যুদ্ধ, ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয় ও দীর্ঘদিনের অচল শান্তি প্রক্রিয়া পশ্চিমা বিশ্বকে অবস্থান পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসে ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর, প্রথম ইনতিফাদার সময় আলজিয়ার্সে ইয়াসির আরাফাতের মুখে। ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলজেরিয়া প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর দ্রুত আরব বিশ্ব, আফ্রিকা, এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের বহু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি জানায়। ২০১০ সালের শেষ ভাগ থেকে ২০১১ সালের শুরু পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা স্বীকৃতির ঢেউ আসে, লাতিন আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলো—আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি—এর নেতৃত্বে। ওই সময় জাতিসংঘ ব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের কৌশল নেয় ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব। এর ফলশ্রুতিতে ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর ইউনেস্কোতে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে ফিলিস্তিন।
বর্তমান অবস্থা
আল জাজিরার তথ্যমতে, বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা মোট সদস্যের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি। তবে এখনো জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ মেলেনি। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় বাধা। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির পক্ষে জনমত ও রাজনৈতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে বেশ কিছু দেশ ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বা দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
নতুন বাস্তবতা
কূটনীতিকরা বলছেন, ইউরোপের আরও দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে তা নিরাপত্তা পরিষদকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করতে পারে। পূর্ণ সদস্যপদ না পেলেও শিগগিরই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের অধিকতর অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব উঠছে। এ স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিক আদালতগুলোতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় ফিলিস্তিন আরও শক্তিশালী অবস্থান পাবে। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিন গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে আইসিজে ও আইসিসিতে পক্ষভুক্ত রয়েছে।
কৌশলগত একঘরে ইসরাইল
বিশ্লেষকরা বলছেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর সিদ্ধান্ত কেবল প্রতীকী নয়—এটি পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের অবস্থান থেকে মৌলিকভাবে সরে আসা। এত দিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব মনে করত, রাষ্ট্র স্বীকৃতি শান্তি আলোচনার শেষ ধাপে আসবে। কিন্তু এবার উল্টো পথে গিয়ে তারা স্বীকৃতিকে শান্তি প্রক্রিয়ার পূর্বশর্তে পরিণত করছে।
এতে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত একা হয়ে পড়ছে। তার ভেটো শক্তি এখনো ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ আটকাতে পারছে বটে, কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর মূল্য দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান কূটনৈতিক বাস্তবতায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি আর কেবল দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক জরুরি অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে ৭৫ শতাংশের বেশি দেশ যখন স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো একসময় অটেকসই হয়ে পড়বে।










