3:00 am, Sunday, 9 November 2025

তবে কি হাসিনার পথেই হাটছে মোদি ! হারাচ্ছেন ভারতের মসনদ!

নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী

Monzu-Info-Tech
Monzu-Info-Tech

ভেতর ও বাইরের নানামুখী চাপে পড়ে বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহর মুঠো কি কিছুটা আলগা হচ্ছে? ১১ বছরের মাথায় এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী কি সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি? প্রশ্নগুলো প্রবলভাবে আলোচিত হচ্ছে ক্ষমতার অলিন্দে।

জল্পনা বাড়িয়ে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। না হলে কৃষিবিজ্ঞানী ও ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক এম এস স্বামীনাথনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মোদি কেন ‘ব্যক্তিগতভাবে চড়া মূল্য চোকানোর’ ইঙ্গিত দেবেন?

ওই সভার আয়োজন করা হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের জোর দড়ি–টানাটানি চলছে। যখন বিশ্বের প্রতিটি দেশের ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইচ্ছেমতো শুল্ক চাপিয়ে দিচ্ছেন। মোদি সেই সভায় যখন ভাষণ দেন, তার ঠিক আগেই ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ট্রাম্প শুনিয়ে দিয়েছেন।

ভারতে কৃষিক্ষেত্রে বাজার বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই সচেষ্ট। বাড়তি শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে কৃষিক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত কোনো রকম ছাড় দেয় কি না, সেই আলোচনাও প্রবল। ওই আবহে মোদি জানিয়ে দেন, কৃষকদের স্বার্থহানি হয়, দেশের পশুপালক ও মৎস্যজীবীরা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন, এমন কিছু তিনি করবেন না। সে কথা বলতে গিয়েই তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এ জন্য আমাকে চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে। তার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু কৃষক, পশুপালক, মৎস্যজীবীদের স্বার্থহানি হতে দেব না।’

সেই থেকে রাজনীতি আলোড়িত। ব্যক্তিগত মূল্য চোকানোর ইঙ্গিত মোদি কেন দিলেন? কী বোঝাতে চাইলেন? চড়া মূল্যর অর্থ কী? ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়া? এসব জল্পনায় রাজনীতি গমগম করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, মোদি অন্তত এটুকু বুঝিয়ে দিলেন খুব একটা স্বস্তিতে তিনি নেই।

প্রধানমন্ত্রী স্বস্তিতে নেই অনেক কারণে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, ঘরে–বাইরের প্রবল চাপ তাঁর স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে।

সাম্প্রতিক যুদ্ধ বন্ধে নিজের ভূমিকা বারবার জাহিরের মাধ্যমে মোদিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে ট্রাম্প কোণঠাসা করছেন। সেই দাবি বন্ধের উপায় কী, আজও মোদি সরকার তা বুঝে উঠতে পারছে না। এই অবস্থাতেই চেপে বসেছে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা। পরিত্রাণের উপায় কী, এখনো মোদির অজানা।
বাইরের চাপ অবশ্যই বন্ধুবর ডোনাল্ড ট্রাম্পের। যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করে তুলতে তিনি যেভাবে সবচেয়ে বেশি শুল্ক ‘বন্ধু’ ভারতের ওপর চাপিয়েছেন এবং ‘পরম মিত্র’ মোদির বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছেন, তা অপ্রত্যাশিত। কাশ্মীর ও পাকিস্তান বরাবরই ভারতের কাছে স্পর্শকাতর। এ বিষয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতা ভারত বরদাশত করে না। এটাই বহু বছরের নীতি।

সাম্প্রতিক যুদ্ধ বন্ধে নিজের ভূমিকা বারবার জাহিরের মাধ্যমে মোদিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে ট্রাম্প কোণঠাসা করছেন। সেই দাবি বন্ধের উপায় কী, আজও মোদি সরকার তা বুঝে উঠতে পারছে না। এই অবস্থাতেই চেপে বসেছে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা। পরিত্রাণের উপায় কী, এখনো মোদির অজানা।

বাইরের এই মারাত্মক চাপের পাশাপাশি ক্রমেই বড় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা। প্রধান সমস্যা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) চাপ। মোদি–শাহর ইচ্ছানুযায়ী বিজেপিকে চলতে দেওয়ার লাইসেন্স দিতে সংঘ আর রাজি নয়। নয় বলেই মোদি–শাহ জুটি আজও বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি বেছে নিতে পারেননি। বারবার মেয়াদোত্তীর্ণ সভাপতি জে পি নাড্ডার সময়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। সংঘ চায় তাদের পছন্দের লোক, মোদিরা চান তাঁদের। টানাপোড়েন আজও অব্যাহত।

এর চেয়েও বড় চাপ, ৭৫ বছর পূর্ণ হলে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন কি না, সেই প্রশ্ন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েই মোদি ৭৫–ঊর্ধ্ব সবাইকে সরিয়ে দলের ‘মার্গদর্শক’ (উপদেষ্টা) করে দেন। সরে যেতে হয় লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর যোশি, যশোবন্ত সিং, যশবন্ত সিনহাদের। সেই নিয়ম এবার নিজের ক্ষেত্রে কি প্রয়োগ করবেন মোদি? এটা শুধু প্রশ্নই নয়, চাপও। চাপটা দিচ্ছেন সংঘচালক মোহন ভাগবত নিজেই। নানাভাবে তিনি সে কথা মনেও করিয়ে দিচ্ছেন।

গত জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কেউ যদি শাল উপহার পান, তাহলে তার অর্থ এবার সরে যান। অন্যদের কাজ করতে দিন। নরেন্দ্র মোদির চেয়ে মোহন ভাগবত মাত্র ছয় দিনের বড়। এই বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবত ৭৫ পূর্ণ করবেন, মোদি ১৭ সেপ্টেম্বর। ভাগবত অবসর নিলে মোদির ওপর সেটা হবে বাড়তি চাপ।
গত জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কেউ যদি শাল উপহার পান, তাহলে তার অর্থ এবার সরে যান। অন্যদের কাজ করতে দিন। নরেন্দ্র মোদির চেয়ে মোহন ভাগবত মাত্র ছয় দিনের বড়। এই বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবত ৭৫ পূর্ণ করবেন, মোদি ১৭ সেপ্টেম্বর। ভাগবত অবসর নিলে মোদির ওপর সেটা হবে বাড়তি চাপ।

ঠিক এই সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সরে যেতে হলো উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়কে। সেটাও যে মোদি–শাহর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণে, আজ তা গোপন নয়। আজ পর্যন্ত ভারতের কোনো উপরাষ্ট্রপতিকে এভাবে অসম্মানিত হয়ে সরে যেতে হয়নি। মোদির আস্থা ধনখড় এতটাই হারিয়েছিলেন যে সংসদ চললেও তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা পর্যন্ত জানানো হলো না। অথচ ধনখড়কে কাছে টেনেছিলেন মোদি নিজেই। তিনিই তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করেছিলেন। উপরাষ্ট্রপতিও।

জম্মু–কাশ্মীরের রাজ্যপাল হিসেবে মোদি নিযুক্ত করেছিলেন সত্যপাল মালিককেও। সেই সত্যপাল নানা কারণে প্রকাশ্যে মোদির নীতি বিরোধিতা শুরু করেন। এবার ‘অবাধ্য’ হলেন ধনখড়। সংঘের আদর্শের বাইরের লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে এখন প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে আরএসএস। উপরাষ্ট্রপতি পদেও তাই সংঘকে উপেক্ষা করে নিজের মনের মতো কাউকে প্রার্থী বাছতে পারছেন না মোদি–শাহ।

দুই জাট নেতার প্রতি মোদি-শাহর এই মনোভাব জাট সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। রাজস্থানের জাট নেতা ও বিজেপির মুখপাত্র কৃষ্ণকুমার জানু এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় গত শুক্রবার দল তাঁকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাট মহলে এ নিয়ে ব্যাপক অশান্তি।
মুঠো আলগা হলে নানাভাবে সেটার প্রতিফলন ঘটে। সত্যপাল মালিক সম্প্রতি মারা গেছেন। ২২ বছর বিজেপিতে ছিলেন তিনি। বিহার, ওডিশা, জম্মু–কাশ্মীর, গোয়া, মেঘালয়ের রাজ্যপাল ছিলেন। অথচ মৃত্যুর পর বিজেপির একজনও তাঁর শেষকৃত্যে যাননি। কেউ শোকপ্রস্তাবও পাঠাননি।

‘স্বাস্থ্যের কারণে’ ধনখড়ের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী ‘এক্স’–এ তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করে শুধু বলেন, দেশসেবার অনেক সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। দুই জাট নেতার প্রতি মোদি–শাহর এই মনোভাব জাট সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। রাজস্থানের জাট নেতা ও বিজেপির মুখপাত্র কৃষ্ণকুমার জানু এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় গত শুক্রবার দল তাঁকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাট মহলে এ নিয়ে ব্যাপক অশান্তি।

কৃষ্ণকুমার জানুকে যেদিন বহিষ্কার করা হয়, তার আগের দিন বিজেপির আরেক জাতীয় মুখপাত্র মোহনলুমো কিকন দলত্যাগ করেন। কিকন নাগাল্যান্ডের সাবেক বিধায়ক এবং গোটা উত্তর–পূর্বাঞ্চলের একমাত্র জাতীয় মুখপাত্র ছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে বেড়ে চলেছে বিরোধীদের চাপ। বিহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) নামে যা চলছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সব বিরোধী দল। ইন্ডিয়া জোটকে এতটা এককাট্টা আগে সেভাবে দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের ‘ভোট চুরির’ বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী যে তদন্ত করেছেন, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ইসি কীভাবে বিজেপিকে জেতাতে ‘ভোট চুরি’ করেছে, ইন্ডিয়া জোটের প্রত্যেকের কাছেই তা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ মনে হয়েছে।

এসআইআরের বিরুদ্ধে আগামী সোমবার সংসদ ভবন থেকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতারা নির্বাচন কমিশনে যাবেন ‘ভোট চুরি’ ঠেকাতে। ওখানেই শেষ নয়। বিহারের রাজধানী পাটনায় ডাকা হয়েছে সমাবেশ। ১ সেপ্টেম্বর সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকতে রাহুল ও তেজস্বী যাদব ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রত্যেক নেতাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। রাহুল নিজে কথা বলেছেন সবার সঙ্গে।

রাহুল গান্ধী ইসির ভোট চুরির যে তদন্ত প্রকাশ করেছেন, যেখানে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর মহাদেবপুরা নামে এক বিধানসভা আসনের ১ লাখ ২৫০ জন ভুয়া ভোটারের নামধাম–পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সেই অভিযোগ যে অসত্য নয়, সেই প্রতিবেদন তুলে ধরেছে সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেল। গত শুক্রবার ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, মহাদেবপুরার এক ঠিকানায় ৮০ জন ভোটারের নাম সত্যিই নথিভুক্ত।

মহাদেবপুরার সেই ঠিকানার মালিক, সেখানকার ব্লক আধিকারিকের মন্তব্যও ওই প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। অভিযোগ কেউই অস্বীকার করেননি। যে গণমাধ্যম ‘গোদি মিডিয়া’ বলে পরিচিত, সেখানে এ ধরনের প্রতিবেদন মোদি–শাহর বজ্র আঁটুনি শিথিল হওয়ার কোনো লক্ষণ কি না, সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে।

যেমন শুরু হয়েছে রাহুলের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা। ১৭ আগস্ট বিহারের সাসারাম থেকে তেজস্বী যাদবের সঙ্গে তিনি শুরু করছেন ‘মতদাতা অধিকার যাত্রা’। বিহারের সীমাঞ্চল ও মিথিলাঞ্চলের ১০০ বিধানসভা আসনে তাঁরা যাবেন। কখনো হেঁটে, কখনো গাড়িতে। সেটাই হতে চলেছে ইন্ডিয়া জোটের নির্বাচনী প্রচারের প্রথম ধাপ। যাত্রা শেষে ১ সেপ্টেম্বর হবে পাটনায় জনসভা।

বিহারের নির্বাচন নিশ্চিতভাবেই অনেক কিছুই প্রমাণ করবে। তার আগে অনেক ওলটাপালট হওয়ার সম্ভাবনা। ট্রাম্পের শুল্কনীতির পরিণতি, নরেন্দ্র মোদির ৭৫ বছর বয়স। বিহারের ফল বোঝাবে মোদি–সরকার ও ভারতের ভবিষ্যৎ কোন দিকে বাঁক নেবে। মোদি বাস্তবিকই স্বস্তিতে নেই।

Write Your Comment

About Author Information

Bangladesh Diplomat বাংলাদেশ ডিপ্লোম্যাট

Bangladesh Diplomat | বাংলাদেশ ডিপ্লোম্যাট | A Popular News Portal Of Bangladesh.
Popular Post

তবে কি হাসিনার পথেই হাটছে মোদি ! হারাচ্ছেন ভারতের মসনদ!

Update Time : 09:02:45 pm, Saturday, 9 August 2025

ভেতর ও বাইরের নানামুখী চাপে পড়ে বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহর মুঠো কি কিছুটা আলগা হচ্ছে? ১১ বছরের মাথায় এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী কি সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি? প্রশ্নগুলো প্রবলভাবে আলোচিত হচ্ছে ক্ষমতার অলিন্দে।

জল্পনা বাড়িয়ে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। না হলে কৃষিবিজ্ঞানী ও ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক এম এস স্বামীনাথনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মোদি কেন ‘ব্যক্তিগতভাবে চড়া মূল্য চোকানোর’ ইঙ্গিত দেবেন?

ওই সভার আয়োজন করা হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের জোর দড়ি–টানাটানি চলছে। যখন বিশ্বের প্রতিটি দেশের ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইচ্ছেমতো শুল্ক চাপিয়ে দিচ্ছেন। মোদি সেই সভায় যখন ভাষণ দেন, তার ঠিক আগেই ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ট্রাম্প শুনিয়ে দিয়েছেন।

ভারতে কৃষিক্ষেত্রে বাজার বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই সচেষ্ট। বাড়তি শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে কৃষিক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত কোনো রকম ছাড় দেয় কি না, সেই আলোচনাও প্রবল। ওই আবহে মোদি জানিয়ে দেন, কৃষকদের স্বার্থহানি হয়, দেশের পশুপালক ও মৎস্যজীবীরা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন, এমন কিছু তিনি করবেন না। সে কথা বলতে গিয়েই তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এ জন্য আমাকে চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে। তার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু কৃষক, পশুপালক, মৎস্যজীবীদের স্বার্থহানি হতে দেব না।’

সেই থেকে রাজনীতি আলোড়িত। ব্যক্তিগত মূল্য চোকানোর ইঙ্গিত মোদি কেন দিলেন? কী বোঝাতে চাইলেন? চড়া মূল্যর অর্থ কী? ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়া? এসব জল্পনায় রাজনীতি গমগম করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, মোদি অন্তত এটুকু বুঝিয়ে দিলেন খুব একটা স্বস্তিতে তিনি নেই।

প্রধানমন্ত্রী স্বস্তিতে নেই অনেক কারণে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, ঘরে–বাইরের প্রবল চাপ তাঁর স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে।

সাম্প্রতিক যুদ্ধ বন্ধে নিজের ভূমিকা বারবার জাহিরের মাধ্যমে মোদিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে ট্রাম্প কোণঠাসা করছেন। সেই দাবি বন্ধের উপায় কী, আজও মোদি সরকার তা বুঝে উঠতে পারছে না। এই অবস্থাতেই চেপে বসেছে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা। পরিত্রাণের উপায় কী, এখনো মোদির অজানা।
বাইরের চাপ অবশ্যই বন্ধুবর ডোনাল্ড ট্রাম্পের। যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করে তুলতে তিনি যেভাবে সবচেয়ে বেশি শুল্ক ‘বন্ধু’ ভারতের ওপর চাপিয়েছেন এবং ‘পরম মিত্র’ মোদির বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছেন, তা অপ্রত্যাশিত। কাশ্মীর ও পাকিস্তান বরাবরই ভারতের কাছে স্পর্শকাতর। এ বিষয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতা ভারত বরদাশত করে না। এটাই বহু বছরের নীতি।

সাম্প্রতিক যুদ্ধ বন্ধে নিজের ভূমিকা বারবার জাহিরের মাধ্যমে মোদিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে ট্রাম্প কোণঠাসা করছেন। সেই দাবি বন্ধের উপায় কী, আজও মোদি সরকার তা বুঝে উঠতে পারছে না। এই অবস্থাতেই চেপে বসেছে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা। পরিত্রাণের উপায় কী, এখনো মোদির অজানা।

বাইরের এই মারাত্মক চাপের পাশাপাশি ক্রমেই বড় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা। প্রধান সমস্যা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) চাপ। মোদি–শাহর ইচ্ছানুযায়ী বিজেপিকে চলতে দেওয়ার লাইসেন্স দিতে সংঘ আর রাজি নয়। নয় বলেই মোদি–শাহ জুটি আজও বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি বেছে নিতে পারেননি। বারবার মেয়াদোত্তীর্ণ সভাপতি জে পি নাড্ডার সময়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। সংঘ চায় তাদের পছন্দের লোক, মোদিরা চান তাঁদের। টানাপোড়েন আজও অব্যাহত।

এর চেয়েও বড় চাপ, ৭৫ বছর পূর্ণ হলে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন কি না, সেই প্রশ্ন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েই মোদি ৭৫–ঊর্ধ্ব সবাইকে সরিয়ে দলের ‘মার্গদর্শক’ (উপদেষ্টা) করে দেন। সরে যেতে হয় লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর যোশি, যশোবন্ত সিং, যশবন্ত সিনহাদের। সেই নিয়ম এবার নিজের ক্ষেত্রে কি প্রয়োগ করবেন মোদি? এটা শুধু প্রশ্নই নয়, চাপও। চাপটা দিচ্ছেন সংঘচালক মোহন ভাগবত নিজেই। নানাভাবে তিনি সে কথা মনেও করিয়ে দিচ্ছেন।

গত জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কেউ যদি শাল উপহার পান, তাহলে তার অর্থ এবার সরে যান। অন্যদের কাজ করতে দিন। নরেন্দ্র মোদির চেয়ে মোহন ভাগবত মাত্র ছয় দিনের বড়। এই বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবত ৭৫ পূর্ণ করবেন, মোদি ১৭ সেপ্টেম্বর। ভাগবত অবসর নিলে মোদির ওপর সেটা হবে বাড়তি চাপ।
গত জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কেউ যদি শাল উপহার পান, তাহলে তার অর্থ এবার সরে যান। অন্যদের কাজ করতে দিন। নরেন্দ্র মোদির চেয়ে মোহন ভাগবত মাত্র ছয় দিনের বড়। এই বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবত ৭৫ পূর্ণ করবেন, মোদি ১৭ সেপ্টেম্বর। ভাগবত অবসর নিলে মোদির ওপর সেটা হবে বাড়তি চাপ।

ঠিক এই সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সরে যেতে হলো উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়কে। সেটাও যে মোদি–শাহর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণে, আজ তা গোপন নয়। আজ পর্যন্ত ভারতের কোনো উপরাষ্ট্রপতিকে এভাবে অসম্মানিত হয়ে সরে যেতে হয়নি। মোদির আস্থা ধনখড় এতটাই হারিয়েছিলেন যে সংসদ চললেও তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা পর্যন্ত জানানো হলো না। অথচ ধনখড়কে কাছে টেনেছিলেন মোদি নিজেই। তিনিই তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করেছিলেন। উপরাষ্ট্রপতিও।

জম্মু–কাশ্মীরের রাজ্যপাল হিসেবে মোদি নিযুক্ত করেছিলেন সত্যপাল মালিককেও। সেই সত্যপাল নানা কারণে প্রকাশ্যে মোদির নীতি বিরোধিতা শুরু করেন। এবার ‘অবাধ্য’ হলেন ধনখড়। সংঘের আদর্শের বাইরের লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে এখন প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে আরএসএস। উপরাষ্ট্রপতি পদেও তাই সংঘকে উপেক্ষা করে নিজের মনের মতো কাউকে প্রার্থী বাছতে পারছেন না মোদি–শাহ।

দুই জাট নেতার প্রতি মোদি-শাহর এই মনোভাব জাট সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। রাজস্থানের জাট নেতা ও বিজেপির মুখপাত্র কৃষ্ণকুমার জানু এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় গত শুক্রবার দল তাঁকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাট মহলে এ নিয়ে ব্যাপক অশান্তি।
মুঠো আলগা হলে নানাভাবে সেটার প্রতিফলন ঘটে। সত্যপাল মালিক সম্প্রতি মারা গেছেন। ২২ বছর বিজেপিতে ছিলেন তিনি। বিহার, ওডিশা, জম্মু–কাশ্মীর, গোয়া, মেঘালয়ের রাজ্যপাল ছিলেন। অথচ মৃত্যুর পর বিজেপির একজনও তাঁর শেষকৃত্যে যাননি। কেউ শোকপ্রস্তাবও পাঠাননি।

‘স্বাস্থ্যের কারণে’ ধনখড়ের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী ‘এক্স’–এ তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করে শুধু বলেন, দেশসেবার অনেক সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। দুই জাট নেতার প্রতি মোদি–শাহর এই মনোভাব জাট সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। রাজস্থানের জাট নেতা ও বিজেপির মুখপাত্র কৃষ্ণকুমার জানু এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় গত শুক্রবার দল তাঁকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাট মহলে এ নিয়ে ব্যাপক অশান্তি।

কৃষ্ণকুমার জানুকে যেদিন বহিষ্কার করা হয়, তার আগের দিন বিজেপির আরেক জাতীয় মুখপাত্র মোহনলুমো কিকন দলত্যাগ করেন। কিকন নাগাল্যান্ডের সাবেক বিধায়ক এবং গোটা উত্তর–পূর্বাঞ্চলের একমাত্র জাতীয় মুখপাত্র ছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে বেড়ে চলেছে বিরোধীদের চাপ। বিহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) নামে যা চলছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সব বিরোধী দল। ইন্ডিয়া জোটকে এতটা এককাট্টা আগে সেভাবে দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের ‘ভোট চুরির’ বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী যে তদন্ত করেছেন, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ইসি কীভাবে বিজেপিকে জেতাতে ‘ভোট চুরি’ করেছে, ইন্ডিয়া জোটের প্রত্যেকের কাছেই তা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ মনে হয়েছে।

এসআইআরের বিরুদ্ধে আগামী সোমবার সংসদ ভবন থেকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতারা নির্বাচন কমিশনে যাবেন ‘ভোট চুরি’ ঠেকাতে। ওখানেই শেষ নয়। বিহারের রাজধানী পাটনায় ডাকা হয়েছে সমাবেশ। ১ সেপ্টেম্বর সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকতে রাহুল ও তেজস্বী যাদব ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রত্যেক নেতাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। রাহুল নিজে কথা বলেছেন সবার সঙ্গে।

রাহুল গান্ধী ইসির ভোট চুরির যে তদন্ত প্রকাশ করেছেন, যেখানে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর মহাদেবপুরা নামে এক বিধানসভা আসনের ১ লাখ ২৫০ জন ভুয়া ভোটারের নামধাম–পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সেই অভিযোগ যে অসত্য নয়, সেই প্রতিবেদন তুলে ধরেছে সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেল। গত শুক্রবার ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, মহাদেবপুরার এক ঠিকানায় ৮০ জন ভোটারের নাম সত্যিই নথিভুক্ত।

মহাদেবপুরার সেই ঠিকানার মালিক, সেখানকার ব্লক আধিকারিকের মন্তব্যও ওই প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। অভিযোগ কেউই অস্বীকার করেননি। যে গণমাধ্যম ‘গোদি মিডিয়া’ বলে পরিচিত, সেখানে এ ধরনের প্রতিবেদন মোদি–শাহর বজ্র আঁটুনি শিথিল হওয়ার কোনো লক্ষণ কি না, সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে।

যেমন শুরু হয়েছে রাহুলের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা। ১৭ আগস্ট বিহারের সাসারাম থেকে তেজস্বী যাদবের সঙ্গে তিনি শুরু করছেন ‘মতদাতা অধিকার যাত্রা’। বিহারের সীমাঞ্চল ও মিথিলাঞ্চলের ১০০ বিধানসভা আসনে তাঁরা যাবেন। কখনো হেঁটে, কখনো গাড়িতে। সেটাই হতে চলেছে ইন্ডিয়া জোটের নির্বাচনী প্রচারের প্রথম ধাপ। যাত্রা শেষে ১ সেপ্টেম্বর হবে পাটনায় জনসভা।

বিহারের নির্বাচন নিশ্চিতভাবেই অনেক কিছুই প্রমাণ করবে। তার আগে অনেক ওলটাপালট হওয়ার সম্ভাবনা। ট্রাম্পের শুল্কনীতির পরিণতি, নরেন্দ্র মোদির ৭৫ বছর বয়স। বিহারের ফল বোঝাবে মোদি–সরকার ও ভারতের ভবিষ্যৎ কোন দিকে বাঁক নেবে। মোদি বাস্তবিকই স্বস্তিতে নেই।