ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সম্পত্তিগত অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বর্তমানে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। আর তাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমর্থিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর যোগসাজসে যেভাবে মুসলমানের উপর হামলা-মামলা থেকে শুরু করে মসজিদ-মাদরাসা গুড়িয়ে দেওয়াসহ মুসলমানদের হত্যা করছে তা ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলিদের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশজুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা মুসলিমদের উপর সংঘঠিত সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোমাংস ভক্ষণ, গরু রক্ষার নামে মুসলিমদের হত্য, মসজিদ-মন্দির বিবাদ, নাগরিকত্ব আইন (CAA) বিরোধী বিক্ষোভ দমন এবং ওয়াকফ সম্পত্তি দখল- নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায় ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য ও হামলার’ শিকার হয়েছে।
ভারত সরকার চলতি মাসের ৩ এপ্রিল ‘ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫’ -এ সংশোধনী এনে লোকসভায় পাস করেছে। পরদিন (৪ এপ্রিল) বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অনুমোদন পায়। এরপর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই বিলটিতে সম্মতি দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং গেজেট প্রকাশের পর তা আইনে পরিণত হয়।
ওয়াকফ সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে মসজিদ, মাজার, কবরস্থান ও দানকৃত জমি—যার মোট মূল্য ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। নতুন সংশোধনীতে ‘অমুসলিমদেরও ওয়াকফ বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত’ করা হয়েছে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি দাবি করছে, এটি স্বচ্ছতা আনার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু যা মূলত মুসলিমদের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা।
২০২৪-২০২৫ সালে বিজেপি সরকার কর্তৃক প্রণীত ওয়াকফ সংশোধনী বিল এবং মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে ওয়াকফ জমি দখলের ঘটনাগুলো প্রশ্ন তুলেছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ওয়াকফ বোর্ডের তালিকাভুক্ত জমিগুলোকে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে দখল করে নিচ্ছে। এসব জমিতে মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থান থাকলেও সেগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে বা অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ওয়াকফ সম্পত্তি কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
ওয়াকফ হল ইসলামি আইন অনুযায়ী একটি দানমূলক ট্রাস্ট, যেখানে কোনো মুসলিম ব্যক্তি তার সম্পত্তি (জমি, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান) আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। এই সম্পত্তি থেকে আয় ধর্মীয়, শিক্ষামূলক বা সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
ভারতে ৮লাখ ৭ হাজারের বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তি প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই বোর্ডগুলো ভারতের শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বড় জমির মালিক এবং সামগ্রিকভাবে তৃতীয় বৃহত্তম (সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের পরে)।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নির্যাতন :
গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারি বা হিন্দু সংগঠনের দখলে নেওয়া হয়েছে। যা দখল নিতে মোদি প্রশাসন ও পুলিশ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থন দিচ্ছে। ওয়াকফ জমি নিয়ে বিরোধের অজুহাতে মুসলিমদের উপর হামলা, মসজিদ ভাঙচুর এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম নেতারা ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির কথা উল্লেখ করে বলছেন, এটি একটি ‘সাংগঠনিক ইসলামোফোবিয়া’।
উগ্র বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো (আরএসএস, বজরং দল, ভিএইচপি) দাবি করছে, ওয়াকফ সম্পত্তি ‘অবৈধ দখলদারিত্ব’ দূর করার লক্ষ্যে এই বিল প্রয়োজন। তবে বাস্তবে এর মাধ্যমে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আধিপত্য বিস্তার করা হচ্ছে। দিল্লিতে ওয়াকফ ভূমিতে নির্মিত মসজিদ ও স্কুলগুলোকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ ইয়োগী সরকারের আমলে ৫০০টিরও বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি জবরদখলের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
ইন্দোরের ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংস :
গত মাসে ইন্দোর পুরনিগম একটি ১৫০ বছরের পুরোনো মসজিদ ভেঙে ফেলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। এদিকে মধ্যপ্রদেশে গত এক বছরে ৪২টি ওয়াকফ সম্পত্তি অধিগ্রহণের ঘটনা পাশাপাশি ১৮টি মসজিদ/মাদ্রাসা এবং ১২টি কবরস্থানও দখল করেছে তারা। ২০২৩ সালে উত্তরপ্রদেশে ৫০টিরও বেশি মাদ্রাসা বন্ধের আদেশ দেয় মোদি সমর্থিত প্রশাসন।
হিজাব নিষিদ্ধ :
কর্নাটকের উদুপির একটি সরকারি কলেজের ৬ জন মুসলিম ছাত্রী হিজার পরার কারণে ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাদের অভিযোগ, হিজাব পরে ক্লাস করছি এটা শিক্ষকরা পছন্দ করেন না, বকা দিয়ে বের করে দেন। নিয়মিত কলেজে গেলেও অ্যাটেন্ডেন্স দেওয়া হয়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া :
মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারত সরকারকে সতর্ক করে বলেছে, এই বিল ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘন’ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টে ভারতকে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক দেশ’ তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ :
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB) এই বিলকে ‘সাংবিধানিক অধিকারের উপর হামলা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এদিকে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে, ওয়াকফ বিলের উদ্দেশ্য ‘দুর্নীতি দূর করা ও সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা’। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি ‘হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার অংশ’ যা মুসলিমদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে চায়।
বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট :
উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ‘হিন্দুত্ব এজেন্ডা’র বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫’ -এ সংশোধনীর মাধ্যমে মুসলিমদের অর্থনৈতিক দুর্বল করে তাদের শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করছে।
এই বিলের মাধ্যমে হিন্দু ভোট ব্যাংক শক্তিশালী করা যাতে ‘মন্দির নির্মাণ’ বা ‘হিন্দু ঐতিহ্য রক্ষা’র নামে সংঘর্ষ বাড়ে। পাশাপাশি মুসলিমদের ভোটার হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক করা সম্পত্তি হারিয়ে মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হবে। মুঘল-পরবর্তী স্থাপনাগুলো মুছে ফেলে হিন্দু রাষ্ট্রের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার করাও তাদের পরিকল্পনার মাঝে রয়েছে।
বিজেপির মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের কৌশল’। গরু রক্ষার নামে মুসলিম হত্যা, মসজিদ ধ্বংস থেকে অর্থনৈতিক বয়কট—প্রতিটি পদক্ষেপ মুসলিমদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইব্রাহীম জাহিদ, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।