‘পালাব না। কোথায় পালাব! পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব’—বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে গত বছর ২৯ জানুয়ারি এ কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। সেই থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে। শারীরিকভাবে আত্মগোপনে থাকা কাদের ভার্চ্যুয়াল দুনিয়াতেও অনুপস্থিত। সরকার পতনের আগে যিনি প্রায় প্রতিদিন বক্তব্য-বিবৃতি দিতেন, গত সাড়ে চার মাস ধরে তার কোনো বক্তব্য বা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
‘খেলা হবে’ স্লোগানের প্রবক্তা কাদের নিজেই যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। তার অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন চলছে। কেউ বলছেন, তিনি ৫ আগস্ট যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। আবার কেউ ধারণা করছেন, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। আর কিছু মানুষ মনে করছেন, তিনি এখনো দেশের ভেতরেই কোথাও আত্মগোপনে রয়েছেন।
এসব চর্চা আর গুঞ্জনের মধ্যেই দেশের একটি সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত করেছে, তাদের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী গণঅভ্যুত্থানের পর তিন মাস ৫ দিন ওবায়দুল কাদের দেশেই ছিলেন। এই সময়ে তিনি নিরাপদেই ছিলেন। দলের সভাপতির মতো তিনিও ভারতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছেন এই সময়ে। যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন দলীয় সভাপতির সঙ্গে। সেখান থেকে সাড়া মিলেনি। সূত্রের দাবি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের দেয়া বক্তব্যে যারপরনাই বিরক্ত ছিলেন দলের সভাপতি। ‘ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যেই আন্দোলনে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল বলেই দলটির নেতারা মনে করছেন। যে আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনার সরকারকে এক বিধ্বংসী পরিণতি দেখতে হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি জানতে পেরেছে, গত ৮ নভেম্বর ওবায়দুল কাদের শিলং হয়ে ভারতের কলকাতায় পৌঁছান। খবর রয়েছে, তিনি এক বিশেষ স্থানে আয়েসেই দিন কাটাচ্ছিলেন। তবে কীভাবে দেশ ছাড়বেন তার ফন্দি-ফিকির করছিলেন। সবুজ সংকেত আসার পর সড়কপথে তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী শিলং পৌঁছান। সেখান থেকে যান কলকাতা। দিল্লি নয়, কলকাতাতেই তিনি অবস্থান করবেন এমনটাই জানা গেছে। ভারত সরকারের কাছে তার জন্য কেউ কেউ লবি করছিলেন।
প্রকাশিত এই প্রতিবেদন তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মঙ্গলবার (১৮ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনালকে বলেন, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তিন মাস দেশে ছিলেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেনি। কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হলো না, কীভাবে তিনি দেশের বাইরে গেলেন—এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ব্যাখ্যা দেওয়ার আবেদন জানান তিনি।
পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকা সত্ত্বেও ওবায়দুল কাদেরের দেশত্যাগ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বা তিনি পরে কীভাবে দেশের সীমান্ত অতিক্রম করলেন, সে বিষয়ে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাখ্যা দিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান আইনজীবী তাজুল ইসলাম।
কেউ যদি আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও কাউকে পালাতে সাহায্য করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, ওবায়দুল কাদের তিন মাস দেশের ভেতরে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন, তা সরকারের জানা ছিল না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ওবায়দুল কাদের কোথায় ছিলেন, আমরা যদি জানতাম ধরে ফেলতাম। মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
এক সাংবাদিক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানতে চেয়েছেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তিন মাস বাংলাদেশে লুকিয়ে থেকে কীভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন? জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘উনি কীভাবে জানলেন, তিন মাস লুকিয়ে ছিলেন। আমরা তো জানি না। আমরা যদি জানতাম ধরে ফেলতাম। ওই খবর যদি আমাদের দিতেন লুকিয়ে আছে, অবশ্যই ধরে ফেলতাম। আপনারা একটা উদাহরণ দেন যে কেউ লুকিয়ে আছে আমরা জেনেও তাকে ধরিনি। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না।’