মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুইজ্জু এক বছর আগে দায়িত্ব গ্রহণ করে চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল।
গত সোমবার ভারত এবং মালদ্বীপ তাদের সম্পর্ক ‘রিসেট’ করে নতুন করে উন্নত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে।
ভারতেরে সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দিল্লি সফর এসেছে এমন সময়ে, যখন ভারতীয় মহাসাগরের এই দীপপুঞ্জ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
মুইজ্জু ক্ষমতায় এসে তার দেশে ভারতের প্রভাব কমিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করার এক বছর পর এই সফর দুই দেশের সম্পর্কে মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
সোমবার মুইজ্জু সাংবাদিকদের নয়া দিল্লিতে বলেন, ‘মালদ্বীপের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার এবং তারা সব সময় মালদ্বীপের প্রয়োজনে আমাদের পাশে ছিল।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মুইজ্জু ভারতে আসেন যখন তার ছোট দেশ অর্থনৈতিক মন্দার সাথে লড়াই করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে মালদ্বীপ ঋণ খেলাপি হবার ঝুঁকিতে আছে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তিনি আর্থিক সাহায্য চাইছেন।’
ভারত একটি আর্থিক সাহায্য প্যাকেজ-এ সম্মত হয়েছে, যার মধ্যে ৪০ কোটি ডলারের মুদ্রা বিনিময় চুক্তি অন্তর্ভুক্ত। সহযোগিতা জোরদার করতে নয়া দিল্লি যেসব চুক্তির কথা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে রয়েছে মালদ্বীপে একটি নতুন বন্দর নির্মাণ এবং প্রধান দ্বীপগুলোর মধ্যে আধুনিক পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে কাজ ত্বরান্বিত করা। দুই দেশ শুল্ক-মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করার পরিকল্পনাও করছে।
মালদ্বীপকে ‘একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করে মোদি বলেন যে, ‘আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আমরা একটি সার্বিক অর্থনৈতিক এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা পার্টনারশিপ গ্রহণ করেছি।’
মুইজ্জুর পাঁচ দিনের ভারত সফর আগামীকাল বৃহস্পতিবার শেষ হবার কথা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত করতে সক্ষম হয়েছে।
মুইজ্জুর চীনপন্থী অবস্থান তার পূর্বসূরির নীতি উল্টে দিয়েছিল। তার পূর্বসূরি বেইজিংয়ের কাছে মালদ্বীপের ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারতে আসার আগেই জানুয়ারিতে বেইজিং সফর করেন, যেটা ভারতে একটি কূটনৈতিক অপমান হিসেবে দেখা হয়েছিল। কারণ, মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্টের প্রথম বিদেশ সফরে নয়া দিল্লি যাওয়ার যে দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ ছিল, মুইজ্জু সেটা ভঙ্গ করেন।
তার প্রশাসন বেইজিংয়ের সাথে একটি সামরিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং চীনের একটি গবেষণা জাহাজকে মালদ্বীপের বন্দরে নোঙ্গর ফেলতে দেয়। বছরের আগের দিকে, দুর্যোগ এবং মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য যে ৮০ জন ভারতীয় সৈন্য মালদ্বীপে অবস্থান করছিল, মুইজ্জু তাদের চলে যেতে বলেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তার সরকারের ভারত-বিরোধী অবস্থান সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বদলেছে এবং দুই দেশ তাদের সম্পর্ক মেরামত করতে সচেষ্ট হয়েছে।
তারা বলছেন, প্রায় বারো শ’ ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ খাদ্যদ্রব্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির জন্য তাদের বিশাল প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরশীল। শত শত মালদিভিয়ান ভারতে যায় স্বাস্থ্য সেবার জন্য।
ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সহজ কাজ হবে না।
নয়া দিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে পররাষ্ট্র নীতির ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্শ পান্ত বলছেন, ‘প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু যখন উপলব্ধি করলেন যে, ভারতকে চটিয়ে কোনো কাজ হবে না, বিশেষ করে এই অঞ্চলে ভারতের মতো অর্থনৈতিক শক্তির কাছ থেকে যে ধরনের সমর্থন তার প্রয়োজন হতে পারে, তখন হিসেব-নিকেশ বদলাতে থাকলো।’
পান্ত ভয়েস অব আমেরিকাকে (ভিওএ) বলেন, ‘সে কারণেই মুইজ্জু প্রশাসনে ভারত-বিরোধী মতামত ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারিয়েছে।’
চীন সম্প্রতি ভারতীয় মহাসাগরে তার উপস্থিতি সম্প্রসারণ করছে। সেই পটভূমিতে মালদ্বীপ চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার ফলে আঞ্চলিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে ভারতে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, মুইজ্জু নয়া দিল্লিতে সে প্রসঙ্গে কথা বলেন।
মুইজ্জু টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে, অন্য দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।’
ভারত আশ্বস্ত
কালিঙ্গা ইন্সটিটিউট অফ ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজ-এর চিন্তামণি মহাপাত্রের মতে, এই বক্তব্য নয়া দিল্লিতে ভারতের জন্য কৌশলগত বিপত্তি নিয়ে উদ্বেগ কমিয়ে আনবে।
মহাপাত্র ভিওএ-কে বলেন, ‘যে লোক ভারতের সামরিক লোকজনকে মালদ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে, তার কাছ থেকে এই কথা বেশ আশ্বস্ত করার মতো।’
মালদ্বীপের সাথে সম্পর্ক পুনরায় চালু করা ভারতের জন্য সহায়ক হবে এই সময়ে, যখন তার সামনে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ আসছে। যেমন বাংলাদেশ, যেখানে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন। বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, হাসিনাকে সমর্থন করার জন্য অনেকে নয়া দিল্লিকে দোষারোপ করে।
পান্ত বলেন, ‘এটা ভারতকে একটা সুযোগ দিবে এই অঞ্চলে নিজের মর্যাদা তুলে ধরার। তারা বলতে পারবে, আমরা এই অঞ্চলে বিপদে পড়া ছোট দেশগুলোকে তাদের সঙ্কটের সময় সাহায্য করতে ইচ্ছুক। একইসাথে, মালদ্বীপের অর্থনীতি যাতে বিপদে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করাও ভারতের স্বার্থে। অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলে অনেক অস্থিরতা রয়েছে।’
গত দু’দশকে মালদ্বীপ নিয়ে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি চীন এবং ভারতের মধ্যে ভু-রাজনৈতিক টানা-হেঁচড়া দেখা গেছে। মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে অবস্থিত, যেখান থেকে সামুদ্রিক পথগুলোর ওপর নজর রাখা যায়।
বিশ্লেষক মহাপাত্রের মতে, বৈশ্বিক অশান্তির সময় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।
মহাপাত্র বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটা ভালো একটি ঘটনা। এই জটিল সময়ে দুইটা যুদ্ধ চলছে, ইউরোপে একটা এবং পশ্চিম এশিয়াতে আরেকটা, যার ফলে জ্বালানি সরবরাহে অনেক জটিলতা এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।’
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা
বিডি/জেডআর