নক্ষত্র আলো ছড়ায়। তেমনিভাবে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে তিনি আলো ছড়িয়ে গেছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন নক্ষত্র।
বাংলাদেশে সচরাচর এ রকম নক্ষত্রের সাহচর্যে যাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, তাঁরা ‘মহাকাশেই’ থাকতে পছন্দ করেন। তবে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।
আমি যে নক্ষত্রের কথা বলছি, তিনি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কেন্দ্রের পরিচালক ড. সালিমুল হক।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন, অথচ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত নন, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গত ২৮ অক্টোবর এই নক্ষত্র আবার মহাকাশে মিলিয়ে গেছেন।
অন্য অনেকের মতো আমিও যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করি, তাঁর সঙ্গে আমারও যে সম্পৃক্ততা অবশ্যম্ভাবী।
আমি যখন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আমার পিএইচডি গবেষণা শুরু করেছি, তখন তাঁকে একটা ই–মেইল করি। তখন তিনি লন্ডনে অবস্থিত আইআইইডিতে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত। আমি ভাবছিলাম, হয়তোবা রিপ্লাই পাব না। আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অত্যন্ত আন্তরিকভাবে তিনি সাড়া দিলেন।
এই থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের শেষ অবধি আমার সঙ্গে সব সময় তাঁর যোগাযোগ ছিল। তারিখ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁর পরামর্শেই আমি আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (সংক্ষেপে আইপিসিসি) কর্তৃক প্রণীত ষষ্ঠ রিপোর্টের কো–অর্ডিনেটিং লিড অথর ড. অদিতি মুখার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করে শেষ পর্যন্ত অথর হিসেবে কাজ করতে পেরেছিলাম।
সম্প্রতি আমি কানাডা রিসার্চ চেয়ারসহ আমার গবেষণা দল গঠন করার জন্য তহবিল পেয়েছি। এই তহবিল পাওয়ার জন্য ড. সালেমুল হক সুপারিশপত্র দিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে আমি নিয়ে গিয়েছি ভেনিসে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও সরাসরি কোনো প্রজেক্টে আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করিনি, তবু পেয়েছি নক্ষত্রের কিছু আলোকচ্ছটা।
১৯৮৮ সালে আইপিসিসি ও ১৯৯২ সালে ইউএনএফসিসি (ইউনাইডেট নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ড. হক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব এবং কীভাবে তা অভিযোজিত হয়, সেটি নিয়ে কাজ করতে থাকেন।
প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কীভাবে কার্বন নির্গমণ প্রশমন করা যায়, কেবল সেটুকুই গুরুত্ব পায়। অভিযোজনের বিষয়টি তখন ধর্তব্যে আসেনি। এ রকম অবস্থায় অভিযোজনকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে যে গুটিকয়েক ব্যক্তি অবদান রেখেছেন, তাঁর মধ্যে ড. সালিমুল হক একজন।
ড. হক শুধু গবেষণায় তাঁর অবদানকে সীমিত রাখেননি, কীভাবে এ গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিযোজনক্ষমতা বাড়াতে পারে, তাতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজনের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ মৌলিক অবদান আছে। যেমন কমিউনিটি বেসড অ্যাডাপটেশন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজকে আন্তর্জাতিকীকরণ ও বৃহৎ স্কেলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনেক। তিনি কাজ করেছেন প্রাকৃতিক উপায়ে অভিযোজন নিয়ে। এসব কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপৃত করে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মাঝে জলবায়ু অভিযোজনের রোল মডেল করতে মোটাদাগে সালেমুল হকের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে দেনদরবার ও দর-কষাকষিতে তিনি আজীবন বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন। এই দেশগুলো কীভাবে উন্নত দেশগুলো থেকে তাদের ন্যায্য হিস্যা পেতে পারে, তা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। এভাবে তিনি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সমতা নিশ্চয়তা করার চেষ্টা করে গেছেন।