বে-নজির আহমদ: এটা বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের সাফল্যের বড় স্বীকৃতি এবং বিশ্ব জনস্বাস্থ্যে কালাজ্বর নির্মূলে প্রথম দেশ হিসেবে ইতিহাস হয়ে রইল, যে ইতিহাস কোনো দিন মুছে যাবে না। এই স্বীকৃতির চেয়ে বড় দিক হলো, দেশের ১০০টির বেশি উপজেলায় কালাজ্বরের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি। যে রোগে অসংখ্য লোক প্রাণ হারিয়েছে, অসহায়ভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনেছে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ, সেই ভয়াল রোগ থেকে স্বস্তি একটা বড় প্রাপ্তি। তবে এখানেই শেষ নয়, জনস্বাস্থ্যের নিরিখে অর্জিত এই নির্মূল সাফল্য (উপজেলা পর্যায়ে ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ১ জনের কম কালাজ্বর) কালাজ্বরের শেষ সংক্রমণটি বন্ধ করে কালাজ্বরমুক্ত বাংলাদেশের জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এই রোগের যাতে পুনরোদ্ভব না ঘটে, তার জন্য দীর্ঘদিন ধরে রোগ নজরদারি করে যেতে হবে।
কালাজ্বর রোগটি সম্পর্কে বিশদে কিছু বলুন। এটি কত পুরোনো, কীভাবে হয়, কার মাধ্যমে ছড়ায়?
বে-নজির আহমদ: কালাজ্বর বাহকবাহিত একটি পরজীবীঘটিত রোগ। এটি পরজীবী বেলেমাছি বাহকের মাধ্যমে ছড়ায়। কালাজ্বরে আক্রান্ত মানুষ এই রোগের উৎস হিসেবে কাজ করে। কালাজ্বর মানুষের রক্ত তৈরির আধারকে আক্রমণ করে রক্তাল্পতা এবং প্রতিরোধক্ষমতাকে অকার্যকর করে অন্যান্য সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এ অবস্থায় চিকিৎসাহীন থাকলে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। কালাজ্বরের রোগী দীর্ঘমেয়াদি জ্বরে ভোগে এবং প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, রক্তাল্পতা হয় এবং ওজন কমে যায়।
যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে, তবে শিশুদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়। রোগটি ঠিক কত পুরোনো তা বলা কঠিন; প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে এ রোগ সম্বন্ধে জানা যায়। তবে প্রায় ২০০ বছর আগে যশোর অঞ্চলে কালাজ্বর মহামারিতে ২৮ হাজারের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকাজুড়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। একসময় বিশ্ব কালাজ্বরের ৮০ শতাংশ হতো এই দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ, ব্রাজিল এবং আফ্রিকার একটি দেশে।
এখন বিশ্বে কালাজ্বর পরিস্থিতি কেমন? এটি কোথায় কোথায় ছড়ায়?
বে-নজির আহমদ: এখন বছরে ৭০ হাজারের মতো মানুষ কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ব্রাজিল, ভারত এবং পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশে বেশি সংখ্যায় মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশ এই পাঁচটি দেশের মধ্যে নির্মূল কার্যক্রমে সর্বাধিক সাফল্য দেখিয়েছে। তবে নেপাল ও ভারতও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমি ভারতে কালাজ্বর কর্মসূচি স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন টিমের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অর্জন দেখেছি।
ভারতও অদূর ভবিষ্যতে নির্মূল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে। নেপাল পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মারপ্যাঁচে, সমতল ভূমিতে সফলতা পেলেও পাহাড়ি উচ্চভূমিতে নবোদ্ভূত হচ্ছে কালাজ্বর। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচি সাফল্যের পথে হাঁটছে। তবে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর কালাজ্বর পরিস্থিতি আমাদের আগের অবস্থার মতো ভয়াবহ। এই দেশগুলোর জন্য আঞ্চলিক কালাজ্বর কর্মকৌশল প্রণয়নের জন্য আমি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে যাওয়ার সুবাদে সমস্যার ব্যাপকতা ও বহুমাত্রিকতা প্রত্যক্ষ করেছি।